Profile Image

Muhammad Farid Hasan

Writer, Researcher & Journalist
Menu
Story Image

বেগম : নারীদের জাদুময় জাগরণ

ব্রিটিশ শাসনামল। অশিক্ষা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে ছিল ভারতবর্ষ। নারীরা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন। বিরূপ সমাজ, বিরূপ সমাজের মানুষ। কীভাবে আলো আসবে? 

নারীদের অগ্রসর করার চিন্তা করছিলেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। নারীদের শিল্পমনস্ক করতে তিনি ১৯৩০ সালে সওগাত-এর নারীসংখ্যা প্রকাশ করেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সওগাত-এর নারীসংখ্যা নিয়মিত বের হতো। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি নারীদের সাহিত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ এবং প্রগতিশীল করতে কেবল নারীদের জন্যে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। 

১৯৪৭ সালে ২০ জুলাই। কলকাতার ১২ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে প্রথমবারের মত সাপ্তাহিক বেগম প্রকাশিত হয়। এর প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি। মূল্য ছিল চার আনা। এটিই উপমহাদেশের নারীদের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক। বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন চাঁদপুরের সন্তান নূরজাহান বেগম।


বেগম প্রথম সংখ্যাতেই বাজিমাত। প্রকাশের পর চারদিকে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। হিন্দু-মুসলমান সবাই সংখ্যাটি সংগ্রহ করে। কারণ হিন্দু-মুসলমান নারীদের জন্যে এটিই ছিল প্রথম পত্রিকা। এর আগে নারীদের নিয়ে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের কথা কেউ ভাবেননি। প্রথম বর্ষের ১২তম সংখ্যা প্রকাশের পর সুফিয়া কামাল স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। তখন নূরজাহান বেগম পত্রিকাটির হাল ধরেন। বেগম প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নূরজাহান বেগম বলেছেন, ‘মেয়েরা সাহিত্যচর্চা করুকÑএ উদ্দেশ্য নিয়েই বেগম-এর প্রকাশ। বেগম চায় দেশের মেয়েদের মধ্য থেকে কুসংস্কার দূর করে, অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে, জীবনের সমস্ত ভার স্বেচ্ছায় ও সাহসের সঙ্গে, সার্থকতার সঙ্গে বহন করার বাণী শোনাতে।’ 

বেগম পত্রিকার অনুষঙ্গ ও গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্যটি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘পিতা এবং কন্যা সমাজে নারীদের অগ্রগতি যেভাবে চিন্তা করতেন, ঠিক সে বিষয়গুলো বেগম পত্রিকায় প্রতিফলিত হতো। শুরু থেকেই বেগম পত্রিকায় নারীদের গৃহকর্মের কথা, ছবি এবং তাদের নানা সমস্যার কথা প্রকাশিত হতো। এই বেগম পত্রিকা তৎকালীন সমাজে নারী পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা এবং তাদের জন্য সাংস্কৃতিক বিনোদন দেবার একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল।’

বেগম পরবর্তীকালে ব্যাপক খ্যাতি পেলেও এর প্রথমদিকের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। এ পত্রিকার সূচনালগ্নে পুরুষরাও লিখতেন। নারীদের লেখাপ্রাপ্তি ছিল কষ্টসাধ্য বিষয়। কারণ সামাজিক বাধা ছিল প্রবল। তখনকার দিনে নারীদের হাতের লেখা দেখা, কণ্ঠস্বর শোনা, সাহিত্য চর্চা ছিল নিষিদ্ধ কাজ। সেকারণে নূরজাহান বেগম বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেগম-এর জন্যে লেখা সংগ্রহ করতেন। ধীরে ধীরে নারীদের মধ্যে পরিবর্তন এলো। ফলে একসময় বেগম পত্রিকায় কেবল নারীদের লেখাই স্থান পেত। বেগমে লিখেছেন কবি সুফিয়া কামাল, শামসুন নাহার মাহমুদ, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, হামিদা খানম, মহসীনা আলী, সাঈদা খানম, হোসনে আরা মোদাব্বের, হুসনা বানু খানম, লুলু বিলকিস বানু, মালেকা পারভীন বানু, মাজেদা খাতুন, সারা খাতুন, জাহানারা আরজু, লায়লা সামাদ, নূরজাহান মুর্শিদ, মাফরুহা চৌধুরী প্রমুখ। ড. মুহম্মদ শহীদল্লাহ্, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, মন্ত্রী হবীবুল্লাহ বাহার, মোহাম্মদ মোদাশ্বের, আহসান হাবীব, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, ফয়েজ আহমদ, ফজলে লোহানী, আবুল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মুতী প্রমুখ বেগম-এর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। 

 বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগম তাঁর জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী মোতাহের হোসেন, আবুল ফজল প্রমুখের বিশেষ স্নেহ লাভ করেন। নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর অনেক স্মৃতি রয়েছে। নূরজাহান বেগম বিশেষ একটি স্মৃতির কথা প্রায়ই বলতেন : “কবি ডেকে উঠলেন, ‘তুই দিল্লি যাবি? দিল্লি কতভাবে যাওয়া যায়, তাই না? রেলগাড়িতে যেতে পারিস, বাসে চড়ে বা উড়োজাহাজে। গন্তব্য কিন্তু একটাই। জীবনের গন্তব্যও তেমনই। ঠিক করে নিতে হবে কীভাবে যাবি।” অর্থাৎ গন্তব্যে পৌঁছানোই মুখ্য কথা। এমন কথা সেদিন নূরজাহান বেগমকে অনুপ্রাণিত করেছিল। 

দেশবিভাগের পর ১৯৫০ সালে বেগম অফিস পুরাণ ঢাকার পাটুয়াটুলি স্থানান্তরিত হয়। এখনো একই স্থানে পত্রিকার অফিসটি রয়েছে। ঢাকায় বেগম-এর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশস্পর্শী। ১৯৬০ ও ’৭০-এর দশকে এর প্রচার সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার। ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হলে এর সভাপতি হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ। সম্পাদক নূরজাহান বেগম। সূচনালগ্নে এ ক্লাবে মাত্র দশ-বারোজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী বছর অনেক নারী এ ক্লাবে যোগ দেন। বেগম ক্লাব নারীদের সমাজমনস্ক করতে এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিতে সাংগঠনিকভাবে সহযোগিতা করেছে। নূরজাহান বেগমের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা পূর্বেও ছিল। তিনি কলকাতার দাঙ্গায় দুস্থদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। পরে মুসলিম ওমেন অ্যান্ড অরফেজ হোম প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগম-এর ভূমিকা ছিল অর্থবহ। নূরজাহান বেগম বলেছেন : ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় সংশ্লিষ্ট খবর আমরা ছাপতাম। যাতে করে নারীরা উদ্বুদ্ধ হয় ও সতর্ক থাকে। তখন কে বা কারা যেন পাকিস্তানিদের বলে দিয়েছে, বেগম অফিসে পাকিস্তানবিরোধী আলোচনা ও মিটিং হয়। বেগমের একটি সংখ্যার প্রথমে আমরা বঙ্গবন্ধুর ছবি পৃষ্ঠাজুড়ে ছেপেছিলাম। তখন আমাদের সুহৃদরা সতর্ক করে বললেন, পাকিস্তানিরা এ ছবি দেখলে প্রেস বন্ধ করে দিবে। আমাদের প্রেসের সামনে বড় একটি কুয়া ছিল। আমরা তখন কয় হাজার বই কুয়ার মধ্যে রেখে মাটিচাপা দিলাম। তখনকার সরকার চেয়েছিল আমরা যেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষ না নিই। কিন্তু আমরা চেয়েছি স্বাধীনতা। স্বাধীনতার জন্যে বেগম লড়েছে।’


বেগম আজ ইতিহাস। শক্ত হাতে পত্রিকার হাল ধরে নূরজাহান বেগম হয়েছেন ভারত উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন, চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে। তাঁর বাবা মুসলমান সাংবাদিকতার পথিকৃৎ সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। তিনিই নূরজাহান বেগমের অনুপ্রেরণার উৎস। নারী জাগরণে ভূমিকা বিবেচনায় তিনি বেগম রোকেয়ার যথার্থ উত্তরসূরি। বর্তমান নারীরা যে সাংবাদিকতা করছে, বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেÑতার পেছনে নূরজাহান বেগমের অনবদ্য অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।

নূরজাহান বেগম শৈশব কাটিয়েছেন তাঁর গ্রামে। শৈশবের স্মৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত আমি গ্রামেই ছিলাম। মনে পড়ে, শৈশবে একবার আমি পুকুরে পড়ে যাই। তখন বাবা বলেছিলেন ওদের কলকাতায় নিয়ে যাই। কেননা বাচ্চা এভাবে পানিতে পড়ে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। ওই সময় আত্মীয়স্বজন আমাদের কলকাতায় যেতে দেয়নি। এরপর আবারও আমি খালে পড়ে গিয়ে পানিতে হাবুডুবু খেয়ে বেঁচে যাই। পর পর বড় দুটো দুর্ঘটনা ঘটার পর আব্বা বড় মামাকে চিঠি লিখলেন যে, ‘অমুক তারিখে কলকাতার শিয়ালদহ ইস্টিশনে আমি অপেক্ষা করব। আপনি আপনার বোন এবং আমার মেয়েকে নিয়ে চলে আসবেন।’ আব্বা কোনো বাধা মানলেন না। সেই সাড়ে তিন বছর বয়সে আমরা কলকাতায় চলে গেলাম।”

নূরজাহান বেগমকে শৈশবে সবাই নূরী বলে ডাকতো। বান্ধবীরা কেউ কেউ ডাকতেন মালেকা। তাঁর দাদি ডাকতেন নুরুন নেসা বলে। স্কুলে ভর্তির সময় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তাঁর নাম রাখেন নুরুন নাহার। পরবর্তীতে তাঁর নানী নিজের নামে নাতনির নাম রাখেন নূরজাহান বেগম। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাইস্কুল থেকে নূরজাহান বেগম মেট্রিকুলেশন পাস করেন। এখানে পড়াকালে তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। নূরজাহান বেগম ১৯৪৪ সালে আইএ এবং ১৯৪৬ সালে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এ কলেজে পড়াকালে নাটক, কবিতার অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন তিনি। 

নূরজাহান বেগম ৭০ বছর নারী অগ্রগতির জন্যে নিরলস কাজ করেছেন, বিশ্রাম গ্রহণ করেননি। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি বেগম সম্পাদনার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। এখন নারীদের সর্বত্র জয়জয়কার, বাধা ভেঙে এগিয়ে চলা, নারীরা পাইলট থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হচ্ছেনÑএই সামগ্রিক সমাজ তৈরিতে নূরজাহান বেগম ও তাঁর সম্পাদিত বেগম পত্রিকা অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে। বেগম রোকেয়া, নূরজাহান বেগমদের হাত ধরে আজ এ উপমহাদেশে নারীরা সার্বিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। 

ব্যক্তিজীবনে নূরজাহান বেগম বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক দাদাভাই রোকনুজ্জামান খানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫২ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। ফ্লোরা নাসরীন খান ও রীনা ইয়াসমিন আহমেদ তাঁদের দু কন্যা। নূরজাহান বেগম কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, একুশে পদক, রোকেয়া পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। এ কীর্তিমান মহান নারী ২০১৬ সালের ২৩ মে মৃত্যুবরণ করেন। 


সূত্র : 

১. বেগম পত্রিকা যেভাবে গড়ে তুলেছিলেন নূরজাহান বেগম, আকবর হোসেন, প্রকাশ ২৩ মে ২০১৬, বিবিসি বাংলা।

২. কিংবদন্তি নূরজাহান বেগমের শেষ সাক্ষাৎকার, সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেখ মেহেদী হাসান, বাংলাদেশ প্রতিদিন, প্রকাশ ২৭ মে ২০১৬

৩. সামাজিক ইতিহাসের আকর : ‘বেগম’ পত্রিকা, মালেকা বেগম, ত্রৈমাসিক প্রতিচিন্তা, সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রকাশ : ৩ এপ্রিল ২০১৭

৪. কালের সাক্ষী নূরজাহান বেগম, তৌহিদা শিরোপা, প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০১১

৫. বৈশাখী টিভিতে প্রকাশিত ভিডিও সাক্ষাৎকার